Charukala Shilpo Niketan

Art and Craft School

Tuesday, April 23, 2019

শিল্পের ব্যাকরণ, অনুপ্রেরণামূলক পর্ব।

ছবি আঁকা শুরু করার কিছু প্রাথমিক পরামর্শ যা সবার গ্রহণযোগ্য।  

                     ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় প্রাচীন যুগের গুহা চিত্রের হাত ধরেই ছবির উদ্ভব। মধ্যযুগেও তার আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। তৎকালীন সময়ে মহারথী আকবরের দারবারেও চিত্র, ভাস্কর্যের  মর্যদা পেয়েছে। এমনাবস্থায় আধুনিক যুগে চারুকলার কদর্য অতুলনীয়। বর্তমানের শিশুকেন্দ্রীক শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্যপুস্তক গুলো চিত্রকেন্দ্রিকতায় ভরপুর। 
সাংস্কৃতিক শিক্ষালয় (বিজ্ঞাপন)

                    ছবি আঁকতে ভালোবাসে না এমন কেউ আছে? আমার মনে হয়, তেমন কোন মানুষ্য খুঁজে পাওয়া দুস্কর। ছোট বাচ্চা থেকে শুরু করে শেষ বয়সের মানুষকে হাতে তুলে নিতে দেখা যায় বিভিন্ন রং-বেরঙের পেন্সিল। কথায় বলে- আট থেকে আশি, ছবি আঁকতে ভালবাসি।
যারা ছবি আঁকতে পছন্দ করে অথচ কিছু মারাত্মক ভুল করে বসে এবং সঠিক দিশায় চলতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের জন্যেই আজকের এই আয়োজন পর্ব। শিল্পের ব্যাকরণ নামাঙ্কিত লেখাটি শেষ পর্যন্ত পড়ার অনুরোধ জানিয়ে শুরু করছি...

ছবি আঁকা শুরু করার প্রয়োজনীয় কিছু উপকরণ:
১. প্রকার ভেদে কাঠ পেন্সিল (এইচবি, ২বি, ৪বি, ৬বি, ৮বি, ১০বি (বাংলায় ট্রান্সলেশন) ইত্যাদি। প্রাথমিক ভাবে আঁকার জন্য ২বি পেন্সিল হলেই যথেষ্ট। পেন্সিলের এই মাপগুলো পেন্সিলের গায়েই যথাযথ লেখা থাকে।
                    তাছাড়া এই সকল উপকরণ গুলো সহজেই ক্রয় করতে পারবে। তুমি চাইলে অনলাইনেও শপিং করতে পারো।
২. ইরেজার (নন ডাস্ট)
৩. কাগজ কাটা ছুরি (বাচ্চারা দূরে থাকবে)
৪. শার্পনার (সবার ব্যবহারযোগ্য)
৫. ছবি আঁকার কাগজ (আর্ট পেপার উপযুক্ত)
৬. কাঠবোর্ড (পেপার সাপোর্টের জন্য)
৭. ক্লিপ (ইজেল ব্যবহারকারী)
৭. স্কেল (শুধুমাত্র মার্জিন দেওয়ার জন্য)
৮. মোম রঙ বা পেস্টেল রঙ (প্রাথমিক), পরবর্তীতে জল রঙ, অয়েল রঙ, ফেভরিক রঙ, সশ রঙ, গ্লাস পেইন্টিং ইত্যাদি।

ছবি আঁকার জন্য প্রয়োজনীয় সচিত্র: 
ছবি আঁকার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ (সংগৃহিত চিত্র ) 

☑️ এসো শুরু করা যাক সমস্যার ঝুড়ি নিয়ে যেগুলো তোমার মনোবল বারবার ভেঙে চলেছ আর তুমি হতাশার শিকার হয়ে চলেছ।

সমস্যার সমাধান পর্ব এক ~                                                            তোমার আঁকা লাইন সোজা হচ্ছে না, তাইতো তবে ভয়ের কিছু নেই। ‘সরল রেখা‘ তথা সোজা লাইন বলতে বাস্তবে কিছু নেই। শুনতে অবাক লাগলেও কথাটি সত্য ‘সোজা লাইন’ শুধুমাত্র ভেক্টরেই পাওয়া যায়, দুটি বিন্দুর মধ্যে সংযোগকারী বিন্দু রেখাতে মিলিত হয়। তথাপি লাইন সোজা না হলে এখানে মন খারাপের কিছু নেই। সেক্ষেত্রে টিপস হলো যেটাই আঁকার চেষ্টা করছো সেগুলোকে ছোটো ছোটো বিন্দু দিয়ে হালকা করে এঁকে বিন্দু গুলো একই রেখায় যুক্ত করে নেও বা বারংবার সোজা দাগ আঁকতেই থাকো যেমন বাংলা দাগকাটা খাতার মতো।

ধীরে সুস্থে আঁকার কৌশল সচিত্রসহ:
ধীরে ধীরে ছবি আঁকার কৌশল

সমস্যার সমাধান পর্ব দুই ~
                   হা হা! ক্ষমাপ্রার্থী একটু হেসে ফেলেছি। অবশ্য হাসার কারন হল তুমি কোনো কিছুই ঠিকমতো আঁকাতে পারছো না, এতে লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই। তুমি চাইলেই একটি সুন্দর দৃশ্য কিংবা একটি সুন্দর ছোট ভীম  এঁকে ফেলতে পারবে না। ধর্য্যতার সঙ্গে অনুশীলন করতে থাকো আর চোখের সামনে যা পাবে তাই আঁকার চেষ্টা করবে। সেটা হতে পারে একটি রুল পেন্সিল, একটি বই অথবা তোমার পছন্দের ঘর যা পরবর্তীতে আঁকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ছবি হুবহু হতেই হবে এমনতো কোনো কথা নেই। যা আঁকতে পারবে সেটাই তোমার কাছে অনেক উপভোগ্য বিষয়।

কচি কাঁচার হাতে একটি সুন্দর চিত্রায়ন:
মহ: রাসের ইমতিয়াজ (রিজিয়া হাদিয়া মেমোরিয়াল একাডেমি)

সমস্যার সমাধান পর্ব তিন ~
                   গড়ন, আয়তন, ওজন পরিমাপ ঠিকঠাক না বুঝে আঁকতে যাওয়া ছবির ক্ষেত্রে খুবই অপরিতপ্ত একটা চর্চা। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। একটি সুন্দর ঘর আঁকার পর যদি দেখ একটি জানালা দরজা থেকেও বড় লাগছে, তাহলে উক্ত ছবির মার্জনার ব্যাপারটা চোখে ধরা দেবে। তাই বলে মন খারাপ হয়ে বসে থাকবে তা নয়।তোমার এটা নিশ্চয় জানো - 'ভুলের মধ্যেই শিখন'। সেই জন্য প্রেসপেক্টিভ ঠিক রাখা নিতান্তই প্রয়োজনীয়।
গ্রাম্য এলাকার মাটির বাড়িগুলোর কথা স্মরণ করতে পারো। হতে পারে দরজার মাপ জানালার তিনগুণ হয়।কিন্ত এমন কিছু আইডিয়া ব্রেনে ঢুকিয়ে রাখ যা তোমার আঁকার জন্য ফলদায়ক হয়। তারপর না হয় পরিবর্তনটি তুমি স্বচোখে উপলদ্ধি কর।

ছবির আকার আয়তনের সচিত্র পরিমাপ:

জ্যমেতির আকারে চিত্রায়ন

সমস্যার সমাধান পর্ব চার ~
                    তোমার আঁকা ছবিগুলো কি প্রাইভেট শিক্ষক বা স্কুল শিক্ষকের মতো হচ্ছে না। তা যদি ভেবে থাক তাহলে তোমার ভাবনাটা ঠিক কারন আমি সে বিষয়ে আগের পর্ব দুই নম্বরে 'অনুশীলনীর' কথাটি বলেছি তা মেনে চলতে পারলেই সঠিকতার পথ খুঁজে পাবে। অনেকেই আছে শিক্ষকের কাছে ছবির মূল ভাবনাটি ফুটিয়ে তুলতে পারে না। তাদের মধ্যে অনেকেই ইউটিউবের বা অনলাইনে শিক্ষকের সাহায্যে ছবি আঁকা শিখে থাকে। তাদের একটি সাধারণ সমস্যা হচ্ছে উপদেষ্টার মতো সঠিকতার সঙ্গে ছবি আঁকতে না পারা। তাদের জন্য আমি প্রথমেই বলবো যা ইচ্ছে তাই আঁক ইচ্ছে করেই হিজিবিজি মনের আর্তনাদ গুলো তোমার সাদা খাতায় আঁকিবুকি রেখা গুলিকে প্রাণবন্তে জাগিয়ে তোলো দেখবে সাদা খাতার রেখা গুলো সত্যিই একটি চমৎকার রূপ সৃষ্টি হয়েছে। যাকে এককথায় বলা যায় 'হাত খুলে আঁকা'। অর্থাৎ মনের মতো করে দাগ কাটাকাটি কর। তবে মনে রাখবে পেন্সিল শক্ত হাতে না ধরে পেন্সিল হাল্কা করে চেপে ধরবে এতে তোমার খাতার ছাপ অন্য পৃষ্টা বুঝতে না পারে। তাই হালকা করে পছন্দমত দাগ কাটতে থাক। সদাসর্বদা একটা কথা মাথায় রাখবে আঁকতে আঁকতে পেন্সিল ছোট হয়ে যাবে তবুও কখন তুমি ছোট হবে না।

সচিত্র আঁকিবুকি:
ছবি সংগ্রহ চারুকলা শিল্প নিকেতন 

সমস্যার সমাধান পর্ব পাঁচ ~
                   এখানে চিত্রকর এবং চিত্রশিল্পীর মধ্যে পার্থক্য অবতারণা দেখা যায়। হুবহুব চিত্র দেখে আঁকা বা কপি করাটি কখনই চিত্রশিল্পীর কাজ হতে পারে না। তবে ছবি শেখার ক্ষেত্রে কপি করাটা শিক্ষনের মাধ্যম বলা হয়।
কল্পনার শক্তিতে তাড়িত হয়ে ছবির রূপ, রস, গন্ধ আরোহন করে; ছবির আকার ও আকৃতির গড়ন দেওয়ায় ছবির সৌন্দর্য্য বিকশিত হয়। কল্পনা থেকে না আঁকতে পারা ছবি আঁকার ক্ষেত্রে একটি মস্ত ব্যর্থতা। তবে এখানেই থেমে থাকলে চলবে না মনে রাখতে হবে রেখার গতি কখনই পরিসমাপ্তি ঘটে না সেই মতো আমাদের চলতে হবে।
মাঝে মাঝে এমন কিছু আঁকতে ইচ্ছা করে যা হয়ত এখন চোখের সামনে নেই। তবুও খাতা নিয়ে বসে পড়লে ক্ষতির কিছু নেই বরং চেষ্টাতে তোমার স্মৃতি সমৃদ্ধ ঘটবে। এই রকম সমস্যা তোমার একার নয়, এই সমস্যা আমাদের সবার মধ্যে কমবেশি রয়েছে। অনেক পেশাদার শিল্পীকেও এ ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়েছে। কল্পনাশক্তি বাড়ানোর জন্য আগে সেই জিনিস সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, তুমি পড়ন্ত সূর্যাস্তের দৃশ্য আঁকতে চাইছো। প্রথমেই তোমার করণীয় কাজ হবে, উক্ত অবস্থায় সূর্যের আভরণ সুচারু ভাবে চাক্ষুস করতে হবে। তোমার মধ্যে পরিপেক্ষিত দৃশ্যানুযায়ী ধারণাটি তৈরি হলেই তুমি মোটামুটিভাবে একটি সুন্দর সূর্যাস্তের ছবি এঁকে ফেলতে পারবে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, এঁকে দেখতে পার।

মেমোরিপ্রাপ্ত সচিত্র: 

নিজের মন থেকে অঙ্কনায়ন 

সমস্যার সমাধান পর্ব ছয় ~

                   অন্তিম পর্ব তথা রঙ বাছাইয়ের পর্ব: অনেক সময় দেখা যায় অতি যত্নে স্কেস করা সুন্দর ছবি খানি শুধুমাত্র রঙ বাছাইয়ের ভুলে পুরো চমকটাই নষ্ট হয়ে গেছে। এখানে অন্তত কিছুটা সময় দেওয়া যেতেই পারে। কে বলেছে গাছের পাতার রঙ গাঢ় সবুজ হতেই হবে। তুমি রঙিন গাছ আঁকলেও সমস্যা হবার কথা নয়, তবে অবশ্যই গাছের কেরেক্টারে ঠিকঠাক রঙ ব্যবহার করতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ডের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে এবং মনে রাখতে হবে ব্যাকগ্রাউন্ডে সব সময় আলো-ছায়া ব্যাপারটি বজায় রাখে। উষ্ণ রং ও শীতল রং গুলো মাথায় রেখে স্কেস করা ছবির উপর নির্ভয়ে রং চাপাও। তেমনি প্রাথমিক এবং যোগিক রঙের তফাৎটা জানা প্রয়োজন, যথাক্রমে লা-হ-নী এবং বে-ণী-আ-স-হ-ক-লা। রঙের মিশ্রণ করতে লাল, হলুদ, নীল, সবুজ ইত্যাদির সাথে মিশ্র রঙের উৎপত্তি অপরপক্ষে নীল, আকাশী বা ধূসর রঙ মিশবে না। রঙ সম্পর্কে প্রতিটা রঙের একটু করে ট্রয়াল করে বা তুলির টানে আঁচড় দিয়ে দেখতে পারো। চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসুর মতে - 'রঙের বেঞ্জনা বোঝা বড়ই কঠিন'। তাই রঙের স্বচ্ছন্দবোধ তোমার হাতের ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তুলতে হবে।

রং মাখানো সচিত্র:
মোম রঙের ছবি 

                      দুটি চক্ষুদ্বয়ের অন্তরাল থেকে দিগন্তরেখা পর্যন্ত যা কিছু দেখবে তার খুঁটিনাটি লক্ষ্য করবে এবং আলো-ছায়া, আকার-আয়তন, পরিমাপ ঠিক করতে পারলে একটি ছবি সম্ভব্য রূপাকৃত আসে। সর্বপ্রথম স্কেচের প্রতি নজর দেওয়া অত্যাবশ্যক। সবকিছু এঙ্গেলে দেখার চেষ্টা করবে। আর কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে মনে থেকে ড্রইং করতে থাকবে। ফলাফল নিয়ে একটু ভাববে না, এখানেও একটি কথা মাথায় রাখবে 'কষ্টেই কেষ্ট মেলে' তাই আগে পিছে না ভেবে শুধু স্কেচ করে যাও। নিজের চতুর্দিকের জিনিস থেকেই শেখার চেষ্টা কর। উদারণসরূপ বলা যায় ইনডোরের মাধ্যমে তোমার বাড়ির রান্না ঘরের সাজ সবজি থেকে শুরু করে যাবতীয় আসবাবপত্র পর্যন্ত সব কিছুই স্কেচ বা স্টিল স্টাডি করতে পারো। এছাড়াও আউটডোরে গিয়েও স্টাডি করতে পারো। যেমন - আম গাছের পাতা, পাকুড় গাছের পাতা, একটি স্থির বাড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ভাবেই নিয়মিত অনুশীলন করতে থাকলে পরবর্তীতে তোমার আঁকা ছবির মধ্যে আমূল পরিবর্তন আসবে। আমার আশা নয় বিশ্বাস তুমি পেরেছো, তুমি পারছো এবং তুমি পারবে। তোমার আত্মবিশ্বাস; তোমার অন্তনিহিত শক্তি; তোমার অন্তরে লুপ্ত অবস্থায় আছে সেটিকে জাগিয়ে তোল, তোমার সাফল্য নিশ্চিত সেই আশা নিয়ে শেষ করলাম। ভালো থাকবে, ধন্যবাদ।
                                      
                                                                        শুভেচ্ছান্তে ~
                                                                        সি.এস.এন